সাভারে ঘুষের রাজা মামুনের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ জনতা

- আপডেট: ১১:০৩:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫
- / ১৮০১৯
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনির:
রাজউকের জোন-৩/২ এর সহকারী অথরাইজড অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন এখন সাভারবাসীর কাছে ভয় ও ঘৃণার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ঘুষ দুর্নীতি ও ভয়ভীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছেন তিনি। সাভার উপজেলা প্রশাসনিকভাবে ঢাকা জেলার অংশ হলেও এখানকার বেশিরভাগ এলাকা পৌরসভার আওতায়। তবুও স্থানীয় জনগণ যুগ যুগ ধরে ইউনিয়ন পরিষদের অনুমোদনে বসতবাড়ি নির্মাণ করে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি মামুন গ্রামেগঞ্জে গিয়ে দাবি করছেন এগুলো নাকি রাজউকের আওতাভুক্ত। ফলে প্রতিটি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে তিনি রাজউকের অনুমতিপত্র ও বাড়ি নির্মাণের কাগজ দেখানোর নাম করে শুরু করেছেন ভয়াবহ হয়রানি। কেউ কাগজ দেখাতে না পারলে তাদের ঘর ভেঙে ফেলার ভয় দেখিয়ে আদায় করছেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। এতে করে সাভারের হাজারো মানুষ আজ দিশেহারা ও অতিষ্ঠ।
রাজউক জোন-৩/২ মূলত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জোন-৩ এর একটি উপ-অঞ্চল, যেখানে অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্বে আছেন আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। কিন্তু এসব দায়িত্বের আড়ালে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর দুর্নীতির সাম্রাজ্য। রাজউকের আটটি জোনের মধ্যে জোন-৩ পরিচালিত হয় মহাখালী অফিস থেকে। যেখানে মিরপুর, বনানী ও গুলশানের মতো অভিজাত এলাকা অন্তর্ভুক্ত। এসব এলাকার অনুমোদন ও দফারফা ঘিরে বছরের পর বছর ধরে চলছে অবৈধ লেনদেন। আর এই সিন্ডিকেটের অন্যতম চালক এখন সহকারী অথরাইজড অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন।
নড়াইল জেলার সদর উপজেলার বেড়ামারা গ্রামের সন্তান আব্দুল্লাহ আল মামুন। আ.লীগ সরকারের রাজনৈতিক সুপারিশে রাজউকে যোগদানের পর থেকেই মামুনের উত্থান শুরু। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের এক প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্যের সুপারিশে ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর রাজউকে প্রধান ইমারত পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেন। পরে অবৈধ প্রভাব ও যোগসাজশের মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অথরাইজড অফিসার হন। বর্তমানে তিনি রাজউক জোন-৩/২ এ কর্মরত। তার দুর্নীতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে ২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর বিভিন্ন গণমাধ্যমে “রাজউক জোন-৩/২ এর সহকারী অথরাইজড অফিসার মামুনে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়, কিন্তু তবুও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রাজউক কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মামুন এখন নিয়মিত সাভারের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে জনগণকে ভয় দেখাচ্ছেন। তিনি দাবি করছেন সব বসতবাড়িই নাকি রাজউকের অধীনে। অথচ এগুলো বরাবরই ইউনিয়ন পরিষদের অনুমোদন অনুযায়ী গড়ে ওঠা বসতি। মামুন এসব বাড়ির মালিকদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলার ভয় দেখিয়ে বলছেন “রাজউকের অনুমতি ছাড়া কোনো ভবন বৈধ নয়”, এরপর শুরু হচ্ছে দফারফার নাটক। রাজউক অনুমতিপত্রের নামে ঘুষের দর কষাকষি। অভিযোগ রয়েছে তিনি প্রতি বাড়ি বা নির্মাণ প্রকল্পে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করেন। টাকা না দিলে ভবন নির্মাণ স্থগিত কিংবা নোটিশ পাঠানোর হুমকি দেন।
এই ভয়ভীতির রাজনীতি এখন সাভারে নিত্যদিনের ঘটনা। মামুনের ঘুষের থাবা থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। কোনো পরিবার নতুন ঘর তুলতে গেলে তাদের কাছে হাজির হন মামুন বা তার প্রেরিত দালালচক্র। স্থানীয় নির্মাণ শ্রমিক থেকে শুরু করে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোও বলছে, মামুন ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। রাজউকের জোন-৩/২ এ কোনো প্ল্যান পাশ বা মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাকে ঘুষ দিতে হয়। একাধিক ঠিকাদার জানিয়েছেন, ভবনের প্ল্যান অনুমোদনের জন্য ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করেন মামুন। এমনকি উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে বা জরিমানা এড়াতে চাইলে আরও বেশি টাকা দিতে হয়।
রাজউকের ভেতরেই এখন গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দুর্নীতির সিন্ডিকেট, যার নেতৃত্বে আছেন মামুন। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও রাজউকের উচ্চপদস্থ মহল নীরব। কারণ মামুন রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট, ফলে প্রশাসনও তাকে ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত চক্র এখন ইমারত বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগে নোটিশ জারি করে ভবন মালিকদের অফিসে ডেকে এনে গোপনে সমঝোতা করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
রাজউকের সূত্র বলছে, মামুনের নামে থাকা সম্পদের পরিমাণ তার বেতনের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি মাত্র কয়েক বছরে কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাজধানী ও নিজ এলাকায় একাধিক প্লট, প্রাইভেট কার, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটসহ তার বিপুল সম্পদ এখন আলোচনার কেন্দ্রে। সহকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন চলছে তার এই অস্বাভাবিক সম্পদবৃদ্ধি ঘুষ ও চাঁদাবাজির ফল। তদন্তের নাম থাকলেও কার্যত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, বরং তাকে আরও ক্ষমতাশালী করা হয়েছে।
সাভারের সাধারণ মানুষ এখন মামুনের নাম শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গ্রামীণ জনপদে তিনি যেভাবে ভয়ভীতি ছড়িয়ে ঘুষ আদায় করছেন তা এক ধরনের প্রশাসনিক সন্ত্রাসে রূপ নিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনুমতি নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করা মানুষ আজ তার কাছে অপরাধী। অভিযোগ উঠেছে মামুনের নির্দেশে কয়েকজন স্থানীয় দালাল মাঠে নেমে গেছে। তারা বাড়ির ছবি তুলে রাজউকের নামে ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করছে, টাকা না দিলে মামুনের নামে মামলা বা ভাঙার নোটিশ পাঠানো হচ্ছে।
রাজউকের অভ্যন্তরীণ কিছু কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মামুনের বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হলেও সেটি গোপনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ তিনি উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ, ফলে রাজউকের ভেতরে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না, বরং যারা প্রতিবাদ করেন তাদের বদলি করে দেওয়া হয়। এভাবে বছরের পর বছর ধরে মামুন নিরাপদে তার দুর্নীতির সাম্রাজ্য টিকিয়ে রেখেছেন।
এলাকাবাসী বলছে, মামুনকে এখন সাভারের ঘুষের রাজা বলা যায়। তিনি এমনভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করছেন যেন রাজউকের সব আইন তার নিজের হাতে। গ্রামবাসী এখন চায় তার স্থায়ী অপসারণ ও দুর্নীতির বিচার। একাধিক মানবাধিকার কর্মী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও বলেছেন, “রাজউক কর্মকর্তাদের মধ্যে মামুন সবচেয়ে ভয়ংকর। তিনি সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে রাজস্বের নামে টাকা নিচ্ছেন, অথচ এর বেশিরভাগই যায় তার পকেটে।
রাজউকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে মামুনের দুর্নীতির খবর জানলেও অজানা কারণে নীরব রয়েছে, হয়তো রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা আর্থিক স্বার্থ তাদের বাধা দিচ্ছে। কিন্তু জনগণ বলছে এভাবে রাজউকের নাম ভাঙিয়ে ঘুষ খাওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে সাভারসহ আশেপাশের এলাকার সাধারণ মানুষ রাজউকের প্রতি আস্থা হারাবে। মামুনদের মতো ঘুষখোর কর্মকর্তা প্রশাসনে থাকলে উন্নয়ন নয় বরং হবে ধ্বংস।
বর্তমানে সাভারবাসী প্রশাসনের কাছে একটাই দাবি দুর্নীতিবাজ আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। তার অবৈধ সম্পদের উৎস অনুসন্ধান ও সিন্ডিকেট ভেঙে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়া। কারণ রাজউকের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে যে ঘুষবাণিজ্য চলছে তা এখন সাভারের প্রতিটি পরিবারের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।